যেকোনো উপায়ে নির্বাচন বানচাল করার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ষড়যন্ত্রকারিরা মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন একের পর এক দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে এবং নামছে। আমরা জানি, গণঅভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও ভারতের দোসররা প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। সেসময় ফ্যাসিবিরোধী সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা রুখে দিয়েছিল। সরকারের মেয়াদের একবছর পার হতে না হতেই আবারও নানা ধরনের ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সরকার যখন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে, তখনই তা বানচালের ষড়যন্ত্র আরও বেগবান হয়েছে। এর মধ্যে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং তার সঙ্গী, যারা সরকারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে ক্ষমতা উপভোগ করছে, তারা নানা বাহানায় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংস্কার, গণহত্যার বিচার, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, জাতীয়পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, নির্বাচনে প্রপোশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতির নিজস্ব দাবি ইত্যাদি নিয়ে তারা সোচ্চার হয়েছে। এসব দাবির অধিকাংশের সাথেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ ৭টি রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব কিছু দাবি নিয়ে এখন আন্দোলনে নেমেছে। দলগুলো ১৮, ১৯ ও ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানী, বিভাগীয় শহর ও জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে। তাদের এই আন্দোলনের নেপথ্যে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া ও বানচাল করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। অন্যদিকে, হাসিনার দেড় দশকে যেসব গোষ্ঠী তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে টুঁ শব্দ করেনি, তারা এখন নানা দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। সভা-সমাবেশসহ সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। গত কিছুদিন ধরে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের ঝটিকা মিছিল দেখা গেছে। সরকার কঠোর অবস্থান নিয়ে তা মোকাবেলা করেছে। তবে রাজধানীতে আওয়ামী লীগ কিছু করতে না পারলেও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ইস্যুর আড়ালে ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গত সোমবার ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে স্থানীয় জনতা থানা ও উপজেলা অফিসার্স ক্লাবে ব্যাপক ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে। তবে এর নেপথ্যে যে আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত নেতাকর্মীরা রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। আমরা এর আগে গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলন ও সহিংসতায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা দেখেছি। এছাড়া, রাজধানীতে দাবি-দাওয়ার নামে যেসব আন্দোলন ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা হয়, তার পেছনেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশ যে নির্বাচন বানচাল ও অস্থিতিশীল সৃষ্টির এক গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আগামী দিনগুলোতে নির্বাচন বানচলের ষড়যন্ত্রের জাল যে আরও বিস্তৃত হবে, তা আঁচ করা যাচ্ছে। অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ষড়যন্ত্রকারিরা ওঁত পেতে বসে আছে। এর একটা বড় উপলক্ষ হতে পারে এ মাসের শেষের দিকে শুরু হতে যাওয়া দুর্গা পূজা। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, দেশে দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে ২৭ সেপ্টেম্বর মহাপঞ্চমীর মাধ্যমে। শেষ হবে ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মাধ্যমে। প্রতিবছরের মতো এবারও প্রায় ৪০ হাজার মন্ডপে পূজা উদযাপিত হবে। ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে বরাবরই দুর্গা পূজা ঈদের চেয়েও বেশি উৎসবমুখর হয়। আশা করা হচ্ছে, এবারও তাই হবে। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রকারিরা যে ‘সংখ্যালঘু কার্ড’ খেলতে চাইবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। বিগত বছরগুলোতেও এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। এ বছর অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত থাকা অস্বাভাবিক নয়। এ সুযোগ নেবে পতিত আওয়ামী লীগ এবং তার প্রভু ভারত। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তাদের দোসরদের দিয়ে দাবি-দাওয়ার নামে সভা-সমাবেশ, সড়ক অবরোধ করিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু রাজনৈতিক দরের কর্মসূচি। যেসব রাজনৈতিক দল আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছে, তা ষড়যন্ত্রকারিদের জন্য ‘মওকা’ তৈরি করে দিচ্ছে কিনা, তা নিয়ে তারা ভাবছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। বলা প্রয়োজন, যেসব দাবিতে তারা কর্মসূচি দিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। হঠাৎ করে আলোচনার টেবিল ছেড়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়া নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, তাদের এই কর্মসূচি স্ববিরোধী এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। নির্বাচন সামনে রেখে আলোচনায় অচলাবস্থা সৃষ্টি এবং দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার পাঁয়তারা ছাড়া কিছু নয়। এটা কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের আচরণ হতে পারে না। যারা রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছে, তা দেশের স্বার্থে নয়, নিজস্ব স্বার্থে দিয়েছে। তাদের এই রাজনৈতিক কর্মসূচি আওয়ামী লীগকে মাঠে নামার সুযোগ করে দেবে। দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যদি তা হয়, তাহলে এর দায় তারা এড়াতে পারবে না। এমনিতেই দেশের মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। তাদের হাতে টাকা নেই। সরকারের হাতেও টাকা নেই। ব্যাংক থেকে ধারদেনা করে চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি, শিল্পোৎপাদনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। শত শত শিল্পকারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বেকারত্বের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। দারিদ্র্যসীমা তলানির দিকে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারিরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সকলেই নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় রয়েছে। তারা নির্বাচিত সরকারের সাথে কাজ করতে উন্মুখ হয়ে আছে। গত রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন সরকারের সাথে কাজ করার অপেক্ষায় রয়েছে। শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নই নয়, অর্থনীতি ও উন্নয়ন কর্মকা-ের সাথে জড়িত প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলোও দ্রুত নির্বাচনের তাকিদ দিচ্ছে। দেশের স্বার্থে ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে সরকারও নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। এমতাবস্থায়, যেখানে ফ্যাসিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করা জরুরি, সেখানে কিছু রাজনৈতিক দল শুধু নিজেদের স্বার্থের দাবি নিয়ে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না, এমন মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
এই আশঙ্কা অমূলক নয়, যদি আগামী নির্বাচন বানচাল হয়, দেশ এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। কারা এটা চায়, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আওয়ামী লীগ ও তার প্রভু ভারত চাইবে, এটা সকলের জানা। তারা কখনোই চাইবে না, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ স্থিতিশীল হোক। অন্যদিকে, কিছু রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থে আন্দোলনে নেমে যেন আওয়ামী লীগ ও ভারতের প্রত্যাশাই পূরণ করছে। তারা দেশের বৃহত্তর স্বার্থ দেখছে না। শুধু নিজ স্বার্থে কীভাবে সংসদে কিছু আসন বাড়ানো বা দুয়েকটি আসন পাওয়া যায়, এ নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। তারা দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করতে চায়। তাদের এই আচরণে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, জনগণের ভোটের ওপর তাদের আস্থা নেই। ভোটের আগেই তারা তাদের আসন নিশ্চিত করতে চায়। তাদের এ ধরনের আচরণ নির্বাচন ও গণতন্ত্রবিরোধী। তাদের সব দাবির প্রতি অন্যান্য রাজনৈতিক দল একমত নয়। ফলে শুধু তাদের দাবি মানতে হবে, অন্যদের আপত্তি উপেক্ষিত থেকে যাবে, এটা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। আমরা মনে করি, কিছু রাজনৈতিক ইস্যুতে যে মতদ্বৈততা দেখা দিয়েছে, তা নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসে ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি। আলোচনার টেবিল থেকে সরে গিয়ে আন্দোলন করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তাদের এই আন্দোলনের ফলে যদি পতিত আওয়ামী লীগ ফিরে আসে, দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং নির্বাচন বানচাল হয়, তাহলে এর দায় তাদের ওপরই বর্তাবে।